ড. মইনুল ইসলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের স্বনামধন্য শিক্ষক। তিনি বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি। এক সময় বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম)- এর মহাপরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন। মইনুল ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর শেষে চট্টগ্রাম বিশ্বদ্যিালয়ে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন ১৯৭৩ সালে। বাংলাদেশ থেকে পুঁজি পাচার বিষয়ে তার অনুসন্ধানী গবেষণা রয়েছে। খেলাপি ঋণের ওপরও তার বড় কাজ রয়েছে। ‘এ প্রোফাইল অন ব্যাংক লোন ডিফল্ট ইন দি প্রাইভেট সেক্টর ইন বাংলাদেশ’ নামে অত্যন্ত মূল্যবান গবেষণা গ্রন্থ রয়েছে তার। ড. মইনুল ইসলাম অর্থনীতির দুর্বৃত্তায়ন নিয়েই বেশি লেখালেখি কিংবা গবেষণা করেন। অর্থ পাচার বিষয়ে কথা বলেছেন টাইমওয়াচের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এ কে নাহিদ
টাইমওয়াচ : বিভিন্ন সমীক্ষার তথ্য মতে, বাংলাদেশ থেকে প্রত্যেক বছরই বিপুল পরিমাণ অর্থ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাচার হচ্ছে। আপনার দৃষ্টিতে অর্থ পাচার হওয়ার কারণ কী?
ড. মইনুল ইসলাম : আপনি ঠিকই বলেছেন যে, দেশ থেকে প্রত্যেক বছরই অর্থ পাচার হচ্ছে। এই অর্থ পাচার হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে, যারা এ দেশে অবৈধভাবে অর্থ আয় করে কালো টাকার মালিক হন; তারা এই অর্থ বিদেশে পাচার করে নিয়ে যান এবং ওই সকল দেশে তারা বিনিয়োগ করে কিংবা পরিবার পরিজন নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। এক্ষেত্রে এই অর্থ নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। আবার ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়ার জন্য পাচার হয়ে থাকে। এই অর্থ পাচার করে এক সময় পাচারকারীও বিদেশে চলে যান। অধিকাংশ পাচারকৃত অর্থই কালো টাক্। দুর্নীতি ও পুঁজি লুটপাটের মাধ্যমে এই অর্থ আয় করা হয়। এ জন্যই এই অর্থ বিদেশে নিয়ে যাওয়ার প্রবণতা বেশি। এটি প্রায় সব দেশেই রয়েছে। গত শতাব্দীর পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকে বিশ্বের অনেক দেশই বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার যুক্তরাষ্ট্রে এবং ইউরোপে পাচার হয়েছে। এ দেশ থেকেও গত ত্রিশ বছর ধরে প্রচুর অর্থ পাচার হয়েছে।
টাইমওয়াচ : এক্ষেত্রে পাচারকৃত অর্থ কিভাবে ফেরত আনা সম্ভব বলে আপনি মনে করেন?
ড. মইনুল ইসলাম : পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনার সম্ভাবনা খুবই কম। আমি মনে করি, কালো টাকা আয়, দুর্নীতি এবং পুঁজি লুণ্ঠন-এগুলো শক্ত হাতে দমন করার ব্যবস্থা থাকলে কালো টাকার জন্ম হবে না। কালো টাকার বিরুদ্ধে লড়তে হলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত হাতে লড়তে হবে। দুর্নীতিই কালো টাকা পাচার হওয়ার সবচেয়ে বড় প্রক্রিয়া। আরেকটা প্রক্রিয়া হলো- সর্বক্ষেত্রে জবাবদিহিতা এবং স্বচ্ছতা আনা হলে পুঁজি পাচারের প্রক্রিয়া কমে যাবে। আমাদের দেশের চেয়ে ইউরোপ-আমেরিকায় জীবনযাত্রার মান অনেক উন্নত। সেহেতু পুঁজি পাচার করে ওইসব দেশে যাওয়ার প্রবণতা কাজ করে। এই অর্থ বাইরে চলে যাওয়ার কারণে আমাদের দেশের অর্থনীতির চাকা গতিহীন হয়ে পড়ছে। আর এই অর্থ উন্নত দেশে বিনিয়োগ করা হচ্ছে এবং তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পালে হাওয়া লাগছে।
টাইমওয়াচ : আপনি বললেন যে, পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা সম্ভব নয়। তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘বিএফআইইউ’ সহ দেশের বিভিন্ন সংস্থা কী কাজ করছে?
ড. মইনুল ইসলাম : অর্থ পাচার রোধে কিছু শক্তিশালী ব্যবস্থা করার চেষ্টা করা হচ্ছে । কিন্তু এগুলো এখনো যথেষ্ট দুর্বল। এই সংস্থাগুলোর ক্ষেত্রে যতোটা বলা হচ্ছে তার তুলনায় কাজ খুবই কম হচ্ছে।
টাইমওয়াচ : আমাদের দেশের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন কী করছে?
ড. মইনুল ইসলাম : এই আইনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিকভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা এখনো তেমনভাবে জোরদার হয়নি। এ ব্যাপারে একটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে যে, পুঁজি পাচারের সুবিধাভোগী প্রধানত উন্নত দেশগুলো। উন্নত দেশগুলো চাইবে অন্য দেশ থেকে পুঁজি পাচার হোক। বিশ্বের পলাতক পুঁজি নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য আমেরিকাতে চলে যায়। আমেরিকার অর্থনীতির জন্য এটি একটি বিশাল ইতিবাচক দিক । তাই তারা সারা বিশ্ব থেকে ধনাঢ্য ব্যক্তিদের পুঁজি আকর্ষণ এবং এটি তাদের অর্থনীতিতে বিনিয়োগ করতে পারে। ফলে তারা কেন চাইবে পুঁজি পাচার বন্ধ হোক?
টাইমওয়াচ : সুইস ব্যাংকে তিন হাজার কোটি টাকার সম্পূর্ণ টাকাই কী বাংলাদেশের পাচার হওয়া না-কি সেখানে প্রবাসীদের অর্থও রয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
ড. মইনুল ইসলাম : এটি বলা কঠিন। সুইস ব্যাংক সর্বোচ্চ গোপনীয়তা রক্ষা করেই বলেই পলাতক পুঁজি তারা আকর্ষণ করতে পারে। সেখানে কোন কোন টাকা গচ্ছিত হয়েছে এটি বলা খুবই কঠিন। তবে খেয়াল রাখতে হবে যে, সুইস ব্যাংক সারা বিশ্বে অত্যন্ত মুনাফাদায়ক ব্যাংকিং করছে। তারা এভাবেই পুঁজি সংগ্রহ করে। তারা পাচার হওয়া টাকা ফেলে রাখে না। সুইস ব্যাংক এসব টাকা আবার বিনিয়োগ করে এবং এর মাধ্যমে সুদ এবং মুনাফা অর্জন করে। এটি সুইস ব্যাংকের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য একটি বিশাল হাতিয়ার। সুতরাং তারা এটি হারাতে চাইবে না।
টাইমওয়াচ : তাহলে পুঁজি পাচার রোধে করণীয় কী?
ড. মইনুল ইসলাম : পুঁজি লুণ্ঠন এবং দুর্নীতির জন্য দুর্নীতি দমন কমিশন এবং সরকারকেই যত্নবান হতে হবে। এর বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। আমাদের এখানে রাজনীতিবিদ, মন্ত্রী, এমপিরা পুঁজি লুণ্ঠন ও দুর্নীতির সাথে কম-বেশি জড়িত। অতএব, তারাই দুর্নীতি করবেন আবার দুর্নীতি দমন করবেন এটিতো হয় না। নিজেরা দুর্নীতি করা যদি বন্ধ না করে তাহলে তারা দুর্নীতি দমন কমিশনকে এভাবে অকার্যকর করে রেখে দেবে। ২০০৭-২০০৮ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন অত্যন্ত কার্যকর হয়ে উঠেছিল। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে গলা টিপে দুর্নীতি দমন কমিশনকে মেরে ফেলেছে।