তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ) অবাঙালি তথা বিহারি অধ্যুষিত শহরের অন্যতম ছিল বগুড়ার সান্তাহার জংশন শহর। সে সময়ে এই শহরে এদের সংখ্যা ছিল ৩০ হাজারের অধিক। নিরীহ-শান্তিপ্রিয় বাঙালিদের উপর তাদের নির্যাতন-নিপীড়ন ছিল বর্ণনাতীত। কথায় কথায় অশ্লীল গালাগাল দেওয়া ছিল তাদের মজ্জাগত অভ্যাস। শহরের চারপাশের গ্রাম থেকে কৃষক-গৃহস্থ ও ব্যবসায়ীদের হাটে-বাজারে বিক্রি করতে আনা বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী নিয়ে দাম না দিয়ে চলে যাওয়া, দাম চাইলে মারপিট করা এমন কি চাকু মারতে উদ্যত হওয়াও ছিল নিত্য দিনের ঘটনা। মোট কথা মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ আর দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে মহান স্বাধীনতা অর্জনের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত বর্বর বিহারিদের এরূপ নানা নির্যাতনÑনিপীড়ন মুখবুঁজে সহ্য করা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেই বজ্রকণ্ঠে ভাষণ দেওয়ার পর সারা দেশের মতো সান্তাহারের স্বাধীনতাকামী বাঙালিরাও উজ্জীবিত হয়ে ওঠেন। পক্ষান্তরে বিহারি জনগোষ্ঠীও আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল মরণ কামড় দেওয়ার জন্য। ৭ মার্চের পর প্রতিদিন বিহারিরা যখন তখন শহরের যত্রতত্র বাঙালিদের উপর হামলা চালাতে থাকে। প্রাণভয়ে শহরের মধ্যে বসবাস করা বাঙালিরা বাসাবাড়ি ছেড়ে আশপাশের গ্রামে আশ্রয় নেন। বিহারিদের এসব কর্মকা-ের প্রতিবাদে প্রায় প্রতিদিনই শহরের চারপাশের গ্রামের মানুষ লাঠিসোটা হাতে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে শহরে প্রবেশের চেষ্টা চালান। কিন্তু সশস্ত্র বিহারিদের গুলি ও বোমা হামলার মুখে বার বার পিছু হটতে বাধ্য হয়। এরকম টানটান উত্তেজনার মাঝে ২৫ মার্চ ঢাকার মতো জংশন সান্তাহারেও নেমে আসে কালরাত। এদিন রাতে বিহারিরা শহরের যুগীপুকুর মহল্লায় অবস্থিত সে সময়ের খ্যাতিমান হোমিও চিকিৎসক ডা. কিসমতের বাড়িতে অতর্কিত হামলা চালায়। তারা ডা. কিসমতকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করে। মরে গেছে মনে করে ফেলে রাখে বাড়ির পাশে। এরপর আগুন ধরিয়ে দেয় তার বাড়িতে। এতে পুড়ে কাঠ কয়লা হয়ে শহীদ হন ডা. কিসমতের স্ত্রী খোদেজা বেগম, শাশুড়ি খিরমন বিবি এবং ওই বাড়িতে আশ্রয় নেয়া আব্দুল মজিদ নামের এক ব্যক্তি। পর দিন ২৬ মার্চ সকালে এখবর ছড়িয়ে পড়লে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন বাঙালিরা।
সে সময় ছাত্রলীগের আদমদীঘি থানা শাখার সভাপতি আজিজুল হক ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোরশেদ খানের আহ্বানে প্রতিবাদ সভা করা হয়। সেখানে সিদ্ধান্ত হয় বিহারিদের এই হত্যাকা-ের সমুচিত জবাব দেওয়া হবে। পর দিন শহরের দখল নেয়ার জন্য সবাইকে প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানানো হয়। এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে ২৭ মার্চ সান্তাহারের ছাতনী, ঢেকড়া, পানলা, প্রান্নাথপুর, ডাঙ্গাপাড়া, কেনলাপাড়া, দরিয়াপুর, তারাপুর, মালশন, সান্দিড়া, দমদমা, কাশমিলা, কায়েতপাড়া, উৎরাইলসহ চারপাশের গ্রামের হাজার হাজার স্বাধীনতাকামী মানুষ মিছিল নিয়ে চারদিক থেকে সান্তাহার অভিমুখে আসছিলেন। সকাল ৮টার দিকে শহরের দক্ষিণ দিক থেকে কয়েক হাজার বাঙালির একটি মিছিল রেলওয়ে ইয়ার্ডের পূর্ব পাশে গো-ভাঙা নামক স্থানে পৌঁছলে বিহারি ও সান্তাহার রেলওয়ে থানার অবাঙালি পুলিশরা গুলি চালাতে শুরু করে। গুলিতে প্রথমে লুটিয়ে পড়ে শহীদ হন সান্তাহারের ঢেকড়া গ্রামের এক সন্তানের জনক মহাতাব হোসেন। তার পর পরই গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন একই এলাকার পানলা গ্রামের আখের আলী। এর কিছুক্ষণ পর গুলিতে শহীদ হন পশ্চিম ছাতনী গ্রামের বাসিন্দা নওগাঁ ডিগ্রি কলেজের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র এসএম আবু জালাল। নিজের চোখে বড় ভাই ও পাশের দুই গ্রামের দুইজনের শহীদ হওয়ার বর্ণনা দেন শহীদ জালালের ছোট ভাই এসএম আবু জাহেদ। আবু জাহেদ আরো বলেন, বিহারিদের নির্বিচারে গুলি ও বোমার বিস্ফোরণ আর গুলিতে শহীদ হওয়া দেখে নিরস্ত্র মিছিলকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে নিমিষেই পিছু হটে চলে যায়। সবাই পিছু হটলে বিহারিরা ওই ৩ শহীদের লাশ নিয়ে গিয়ে রেলওয়ে ইয়ার্ড কলোনি মজদিদের সামনে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে আনন্দ-উল্লাস করে।
সে সময় আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া নেতাদের অন্যতম গোলাম মোরশেদ খান বলেন, যুগীপুকুর ও গো-ভাঙ্গার এঘটনায় আমরা যেমন বিচলিত হয়ে পড়ি তেমন বিক্ষুব্ধও হয়ে উঠি। আমরা যোগাযোগ করি পাশের রাণীনগর থানা সদরের ইউপি চেয়ারম্যান ফিরোজ খান, আওয়ামী লীগ নেতা মীর হোসেন মাস্টারসহ অন্য নেতাদের সঙ্গে। কথা হয় বিহারিদের মোকাবিলা করতে হলে রাইফেল ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই। আলাপে তারা জানান, এজন্য যা করার তা করা হবে। কথামতো ২৭ মার্চ মিছিলে গুলি চালিয়ে ৩ জনকে হত্যা করার প্রেক্ষাপটে রাণীনগরের সহযোগিতা চেয়ে ওই নেতাদের পত্র লিখি। পায়ে হেঁটে প্রায় ৭ কিলোমিটার দূরের রাণীনগরে পত্রটি বহন করে নিয়ে যান সান্দিড়া গ্রামের আব্দুল গফুর জোয়ারদারসহ কয়েকজন।
অপরদিকে সান্তাহার সওজ কারখানা বিভাগ থেকে এক বাঙালি চালককে রাজি করিয়ে জিপ গাড়ি নিয়ে সড়কপথে রাণীনগর যায় সান্তাহারের পশ্চিমছাতনী গ্রামের ইউনুছ আলী মোল্লাসহ কয়েকজন। তারা রাণীনগরের ওই নেতাদের নিয়ে থানার বাঙালি ওসির সঙ্গে আলোচনা করেন রাইফেল দিয়ে সহযোগিতা করতে। তিনি সহযোগিতা করতে রাজি হলেও তা স্বাভাবিক উপায়ে সম্ভব নয় বলে জানান। এক্ষেত্রে থানা লুটের ঘটনা ঘটাতে হবে। ঘটনার সময় তিনি ও থানার অন্যান্য দারোগা ও সিপাহিরা যাতে তেমন প্রতিরোধ না করে সে সহযোগিতা করতে রাজি হন। কথামতো ওই দিন দুপুরের দিকে থানা লুটের জন্য আক্রমণ করা হয়। ওসি, দারোগা ও সিপাহিদের কিলঘুষি দিয়ে অস্ত্রাগার ভেঙে লুট করা হয় ৪৩টি থ্রি নট থ্রি রাইফেল। সেই রাইফেলের সঙ্গে আশপাশ গ্রামের বড় বড় গৃহস্থ বাড়িতে থাকা প্রায় সমসংখ্যক বন্দুক নিয়ে এবার বিহারিদের পাল্টা জবাব দেওয়ার জন্য শহরের চারদিক থেকে আক্রমণ শুরু করলে কোণঠাসা হয়ে পড়ে বিহারিরা। তাদের আগ্নেয়াস্ত্র ও বোমা শেষ হয়ে যাওয়ায় কাবু হয়ে পড়ে। তারা নিজেদের বাসা-বাড়ি ছেড়ে কিছু সান্তাহার ছেড়ে পালিয়ে যায়। অধিকাংশরা তাদের কয়েক নেতার বাড়িতে, স্কুল-কলেজ ও মসজিদে আশ্রয় নেয় সপরিবারে। ফলে শহরের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় বাঙালিদের হাতে। এসময় কয়েকশ বিক্ষুব্ধ ও দুর্ধর্ষ প্রকৃতির বাঙালি সপরিবারে বিহারি নিধনে নেমে পড়ে। এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে এক সময়ের প্রতাপশালী সব বিহারিদের নিধন করে। এ খবর তখন বিবিসি লন্ডনের বাংলা বিভাগ থেকে ব্যাপক প্রচার করা হয়। এর মাধ্যমে সান্তাহার ঠাঁই পায় স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসের পাতায়।
কিন্তু দুঃখের বিষয়, স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতে সান্তাহারের প্রথম এই শহীদদের পরিবারের খোঁজ রাখে না কেউ। না সরকারি-বেসরকারি সংস্থা, না এমপি কিংবা মন্ত্রী। তাদের ভাগ্যে এখনো মেলেনি শহীদ পরিবারের মর্যাদা। সান্তাহারের পশ্চিম ছাতনী গ্রামের সমাজ সেবক জাহাঙ্গীর আলম খান ও তৎকালীন সান্তাহার ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মালেক মজনু বলেন, শহীদ আখের আলীর বংশে কেউ না থাকলেও শহীদ মহাতাবের আছে বৃদ্ধা স্ত্রী ও এক ছেলে। আর শহীদ জালালের আছে তিন ভাই। তারা এখনো প্রত্যাশা করেন স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনার সরকার তাদের পরিবারকে শহীদ পরিবারের মর্যাদা ও রাষ্ট্রীয় প্রাপ্য প্রদানের ব্যবস্থা করবেন।