রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে আসছেই বিরামহীনভাবে। এরা সংখ্যায় প্রায় ১১-১২ লাখে পৌঁছেছে ইতোমধ্যে। থামছে না বাংলাদেশের জনঘনত্বের ওপর আরো অধিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির অব্যাহত চাপ। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক পরিম-লে কূটনৈতিক তৎপরতা অপ্রতুল বলে নানরকম আশঙ্কার কথাই বেশি শোনা যাচ্ছে। তাছাড়া প্রতিদিনই পরিস্থিতি ভিন্নমাত্রায় পরিবর্তিত হচ্ছে ক্রম অবনতির দিকে নানারকম বিবেচনায়।
যতদূর জানা যায়, বাংলাদেশ এখনো পর্যন্ত বিদেশি সংবাদকর্মীদের আনুষ্ঠানিকভাবে রোহিঙ্গাদের অবস্থা সরেজমিন দেখার কোনো ব্যবস্থাও করেনি এ পর্যন্ত। তারপরও বিশ্ববাসী বিচ্ছিন্নভাবে এবং স্থানীয় দেশি-বিদেশি সংবাদ মাধ্যমের প্রচারণায় রোহিঙ্গাদের নজিরবিহীন গণহত্যার বিবরণ পাচ্ছে প্রতিনিয়ত। সরকারি ব্যবস্থাপনায় কূটনৈতিক উদ্যোগের মাধ্যমে মিডিয়াতে ব্যাপক প্রচারের কোনো বিকল্প হতে পারে না।
জাতিসংঘসহ বিভিন্ন মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞের খবর এবং আলোচনা-সমালোচনা প্রকাশিত হওয়ার পরই মিয়ানমারের সরকারি অবস্থার যৎসামান্য পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। রাশিয়া, চীন ও ভারত এখনো তাদের স্ব স্ব অবস্থানে অনড়। মিয়ানমার স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি’র দফতরের মন্ত্রী চ টিন্ট সোয়েরকে ঢাকা সফরে পাঠিয়েছে। সফরে এসে তিনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে আলোচনা করেছেন, বিস্তারিত জানা না গেলেও একটি দ্বিপক্ষীয় ওয়ার্কিং কমিটি গঠনের বিষয়ে একমত হয়েছেন। পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, এতে বাংলাদেশের আগ্রহান্বিত হওয়ার মতো তেমন কোনো পরিস্থিতির আলামত দেখা যাচ্ছে না।
অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায়, এটি মিয়ানমার সরকারের আরেকটি কৌশলমাত্র। মিয়ানমার ১৯৬১ সাল থেকে সুপরিকল্পিত ও নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে রোহিঙ্গাদের হত্যা ও বিতাড়নের দীর্ঘমেয়াদি নকশা অত্যন্ত সফলভাবে বাস্তবায়ন করছে। ১৯৭৮ সালে মিয়ানমার থেকে যারা এসেছিল বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিশেষ চাপের কারণে তাদের অধিকাংশকে ফেরত নিলেও, বেশকিছু রোহিঙ্গা বাংলাদেশে থেকেই যায়। তারা আবার আসে বা মিয়ানমার সরকার আসতে বাধ্য করে ১৯৯১-৯২, ১৯৯৫, ২০১৬ এবং বর্তমান ২০১৭ সালে। ১৯৯২ সালে একটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় কিছুসংখ্যক ফিরে গেলেও প্রায় ৪-৫ লাখ রোহিঙ্গা রয়েই যায়। এবার এ পর্যন্ত ৫-৬ লাখের মতো এসেছে এবং প্রতিদিনই আরো আসছে। মোট ১১-১২ লাখ রোহিঙ্গা এখন বাংলাদেশের ঘাড়ে বোঝার উপর শাকের আঁটির মতো।
মিয়ানমারের মন্ত্রী এলেন, কথাও বললেন; কিন্তু একটি যৌথ সংবাদ সম্মেলন করলেন না। এখানে আমাদের মন্ত্রী যা বললেন আর মিয়ানমারের মন্ত্রী তার দেশে ফিরে গিয়ে যা বললেন, তার মধ্যে স’মিলের চাইতে অমিল বা গরমিলই বেশি। আমরা জানি না জাতিসংঘের অধিবেশনে প্রদত্ত শেখ হাসিনার ৫টি প্রস্তাব সম্পর্কে এবং কফি আনানের সুপারিশ বাস্তবায়ন বিষয়ে মিয়ানমার সরকারের মনোভাব কি? এ বিষয়ে দুই দেশের মন্ত্রী কী আলোচনা করেছেন বা কোনো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কিনা! অবস্থাদৃষ্টে পুরোটাই মিয়ানমারের সময়ক্ষেপণ কিংবা সুকৌশলে বিশ্ববাসীর নজর অন্যদিকে ফেরানোর চেষ্টামাত্র।
সু চি জাতিসংঘে গেলেন না; ভারত, রাশিয়া বা চীন মুখরক্ষার মতো করে আচরণ করছে। সবকিছুর পেছনে গভীর কোনো পরিকল্পনার ছায়া খুব একটা দুর্লক্ষ্য নয়। মিয়ানমার কোনো কিছুই তোয়াক্কা না করে হত্যা ও বিতারণ প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে। একদিকে আলোচনার মতো প্রহসন, অন্যদিকে প্রকাশ্য সরবে মাইকিং করে, আগুন জ্বালিয়ে, বোমা, গুলি করে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাঠাচ্ছে। চীন, রাশিয়া, ভারত এ গণহত্যার মতো মানবিক বিপর্যয় পরিস্থিতির নীরব দর্শক। মানবিক সংকটের চেয়ে তাদের বাণিজ্য স্বার্থ টিকিয়ে রাখার অমানবিক আচরণই মুখ্য। সমস্যা মূলত মিয়ানমার সৃষ্টি করলেও ভুক্তভোগী একমাত্র বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ বিশেষ করে জেনে এসেছে চীন, রাশিয়া, ভারত বন্ধুরাষ্ট্র। তাদের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ব্যাপক। কিন্তু রোহিঙ্গা বিষয়ে মিয়ানমারের সম্পর্কের কাছে বাংলাদেশের খুব গুরুত্বহীন অবস্থা। ভারত কিছু সাহায্য পাঠিয়ে বন্ধুত্বের দায় সারছে। সীমান্ত বেষ্টনী কঠোর নিরাপত্তায় নিñিদ্র করেছে যাতে কোনো রোহিঙ্গা ভারতে প্রবেশ করতে না পারে। আর এই রকম সময়ে ভারত তৃতীয় দফায় ৪০০ কোটি টাকার সাহায্য চুক্তির কথা ঘোষণা দিয়েছে। যেখানে দ্বিতীয় সাহায্য প্রকল্পের একটি টাকাও ছাড় করা হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশিদের মনোভাব ভারতের প্রতি অনুকূল রাখার হীনচেষ্টা বলেই সচেতন মহলের ধারণা।
এছাড়া সম্প্রতি বিদেশ সচিবের ভারত সফরে ভারতের পক্ষ থেকে স্পষ্ট করেই বলে দেয়া হয়েছে, এটা নিছক বাংলাদেশের সমস্যা। ভারত এ বিষয়ে কিছুই করবে না। বাংলাদেশ যদি আশা করে থাকে ভারত বা অন্য বন্ধুরাষ্ট্র বাংলাদেশের হয়ে সব কিছু করে দেবে, তা হবে বোকার স্বর্গবাসের চিন্তা। অন্য কথায় আমাদের কূটনৈতিক দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ মাত্র। কেননা অতীত ইতিহাস বলে মিয়ানমার কখনই তার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন থেকে বিরত থাকেনি। বরং আমাদের কূটনীতিকরা বিষয়টিকে দীর্ঘদিন যাবৎ ভুলে থেকেছেন, অথবা তুচ্ছ সমস্যা ভেবে এর সমাধানকল্পে জোরালো কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। আমাদের আমলাদের কাছে দেশের স্বার্থরক্ষার বিষয়টি কোনো চুক্তির ক্ষেত্রেই খুব বেশি গুরুত্ব পায়নি। রাশিয়ার সঙ্গে পারমাণবিক চুল্লির চুক্তি, চীনের সঙ্গে কিংবা ভারতের সঙ্গে বিভিন্ন প্রকল্প চুক্তির সময় আমাদের দেশের আমলারা রোহিঙ্গা বিষয়টি কোনো না কোনোভাবে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় উত্থাপন করেছেন বলে এ পর্যন্ত কেউ উল্লেখ করেননি।
আমাদের দেশ থেকে মন্ত্রীপর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল অচিরেই মিয়ানমার সফরে যাবেন বলে সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় আমরা যে মিয়ানমার থেকে কিছু অর্জন করতে পারব তেমন সম্ভাবনা ক্ষীণ। বিগত দিনের অভিজ্ঞতায় আমরা মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্র সীমানা সমস্যা নিরসন করতে ব্যর্থ হয়ে আন্তর্জাতিক আদালতের শরণ নিয়েছি। মিয়ানমার সরকার তার দেশের অভ্যন্তরে জাতিসংঘকে অবাধে সাহায্য কার্যক্রম পরিচালনা করতে দিচ্ছে না। সেখানে তারা অবশ্যই বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় অধিকতর আগ্রহ দেখাবে, যা তাদের জন্য স্বাভাবিক। বাংলাদেশের তা মেনে নিয়ে কোনোভাবেই সুবিধালাভের সম্ভাবনা নেই বলেই সামগ্রিকভাবে দেখা যায়।
৫ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা নাগরিক কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশে থাকলেও আমাদের আমলাদের মাথাব্যথা নেই। আমলাদের কাজ দেশ পরিচালনায় সরকারকে সুপরামর্শ দেওয়া। আরো ৫-৬ লাখ রোহিঙ্গা এসে অনুপ্রবেশ করেছে। বাংলাদেশ এখন বহুমাত্রিক সমস্যায় নিপতিত। দিন দিন তা আরো বাড়বে। বিভিন্ন এবং নতুন নতুন নানারকম সামাজিক হুমকি সামনের দিনগুলোতে আমাদের মোকাবিলা করতে হবে। আমলা-কূটনীতিকদের সুদূরপ্রসারী, সুচিন্তিত এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপ বাংলাদেশের এই সংকট মোকাবিলায় অপরিহার্য। শুধু দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় মিয়ানমারকে বাধ্য করা যাবে না তার দেশের নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতে। ফেরত যেতে ইচ্ছুক, অনিচ্ছুক প্রসঙ্গটি আলোচনায় এসেছে। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ কাউকে ডেকে আনেনি, তাই ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয় এখানে অবান্তর। এরা বাংলাদেশের বোঝা, যত দ্রুত সম্ভব এদের ফিরিয়ে নিতে হবে। বাংলাদেশ মানবিক আচরণ করছে, কিন্তু তারও নিশ্চয়ই একটি সীমা আছে। দীর্ঘদিন রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া এক অর্থে মানবতার প্রতি বিশ্বের অবমাননা। এশিয়া তথা সমগ্র বিশ্বের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হওয়ার যে সংকট তৈরি হবে তা কাটিয়ে উঠতে কয়েক দশক সময়ও অপ্রতুল হতে পারে।
লেখক : কবি ও শিক্ষাবিদ, E-mail : karimreza9@gmail.com