১৯৭১ সালের ১১ নভেম্বর, আর ২০১৭ সালের ১১ নভেম্বর কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের গাংরা বাসস্ট্যান্ডের কাছেই বেতিয়ারা নামক জায়গাটি দুটি পরস্পর ভিন্ন ঘটনার সাক্ষী। ঢাকা- চট্টগ্রাম মহাসড়কের গা ঘেঁষে, শেরশাহের আমলের ঐতিহাসিক গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডের পাশেই দৃষ্টি আকর্ষক জগন্নাথ দীঘি। দীঘির কয়েকশ গজ সামনেই বেতিয়ারা। এই মহাসড়ক এক অভূতপূর্ব মহাযুদ্ধের রক্তস্নাত স্মৃতির সাক্ষ্য দেয়।
ওই দিন ঘটনাস্থলে গিয়ে স্মৃতিকাতরতা বা শহীদদের আত্মত্যাগের মহত্ত্ব অনুভব করলেও কোথায় যেন একটা বিরাট শূন্যতা রয়েছে তাও উপলদ্ধি হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে একটিমাত্র ঐক্যবোধ ছিল। যেকোনো কিছুর বিনিময়ে বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করতে হবে। মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর ডাকে সবশ্রেণীর মানুষ দেশরক্ষায় আত্মাহুতি দেওয়ার জন্য সবরকম যুদ্ধে নিয়োজিত হয়। তাদের কোনো ক্ষুদ্র-বৃহৎ প্রাপ্তিযোগের লক্ষ্য ছিল না। তাই দেখা যায় ছাত্র, শিক্ষক, শ্রমিক, কৃষক সবার একমাত্র পরিচয় হয় মুক্তিসেনা, অন্যসব পরিচয় তুচ্ছ হয়ে যায়।
আজকের যিনি মাননীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ওয়াফেস ওসমান ১৯৭১ সালে ছিলেন ছাত্র। তাঁর অধীনেই ৬৮ জনের একটি মুক্তিযোদ্ধা দলের বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশের দিন হিসেবে নির্দিষ্ট হয় ১১ নভেম্বর। ভারতের ভৈরবটিলা এলাকা হয়ে বাংলাদেশের ভিতরে বেতিয়ারা গ্রামের মধ্যদিয়ে তারা গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড পার হবেন। ১১৯ ও ১২০ নম্বর গ্রুপে এই দলে ছিলেন রায়পুরা, নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। দু’ভাগের অগ্রবর্তী দলের দায়িত্বে উপ-অধিনায়ক আজাদ।
ইচ্ছাকৃত ভুল তথ্য দেওয়া কিংবা কোনোভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের আগমনের সংবাদ পাকিস্তানি সেনাদের কাছে পৌঁছে যায় আগেই। নয় মাসের যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা অতর্কিত এমবুশের মুখে পড়েছে, তা বিরল ঘটনা। কিন্তু এই বেতিয়ারায় তা ঘটেছিল। সামনে থাকা যোদ্ধারা প্রবল বিক্রমে যুদ্ধ করে পেছনে থাকা সঙ্গীদের জীবন বাঁচান। উপ-অধিনায়কসহ তিনজন আহত অবস্থায় বন্দি হন, যাদের কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। আরও ছয়জন নৃশংস হত্যার শিকার হন। অনেককেই বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে পাকিস্তানিরা। মোট নয়জন শহীদ হন এইদিন।

প্রতি বছর এখানে কিছু শোকার্ত মানুষ সমবেত হন। তারা আসেন দেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে। রায়পুরা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, হাইমচর এবং ঢাকা থেকেও আসেন কেউ কেউ। তবে বিচ্ছিন্নভাবে। সমন্বিত বা ঐক্যবদ্ধভাবে কেউ আসেন না বলেই অবস্থাদৃষ্টে মনে হলো। যার যার মতো আসেন এবং শহীদদের সম্মান জানিয়ে চলে যান। স্থানীয় মানুষজন উপস্থিত থাকেন না বলেই বলা যায়। প্রশাসনের কোনো সংশ্লিষ্টতা কোথাও দেখা গেল না। দায়সারা গোছের একটি আলোচনা অনুষ্ঠান হলো, কেউ শুনলো বসে, কেউ কথাবার্তায় সময় পার করে দিলো। মঞ্চ বা অনুষ্ঠান স্থানেরও কোনো গুরুত্ব খুঁজে পাওয়া গেল না। মঞ্চের পেছনে একটি ব্যানারও লাগানো যায়নি। উদ্যোক্তা গোছের একজনের কাছে জানা গেলো ব্যানার যথাসময়ে পাওয়া যায়নিÑ যদিও ফরমাশ ছিল।
দর্শনার্থীদের অধিকাংশই এখানে সংবৎসর নিয়মিত আসেন। দূর-দূরান্ত থেকে আবেগাক্রান্ত হয়ে যারা আসেন, তারা অবশ্যই এই মহান সন্তানদের আত্মবিসর্জনের স্মরণ সমাবেশের দীনতায় পীড়িত হন। সাত বছর যাবৎ একটি স্মরণিকা প্রকাশ করা হচ্ছে। যুদ্ধদিনের স্মৃতি যেমন আছে, আছে আত্মীয় কিংবা সহযোদ্ধাদের অসন্তুষ্টির বিবরণ। ইতিহাস এবং সেদিনের ঘটনার বিবরণতো আছেই স্মরণিকায়। তবে সর্বত্রই অনৈক্যের ছাপটি বড় পীড়াদায়ক।
হয়তো এর একটি বড় কারণÑ এই যোদ্ধাদের নেতৃত্ব ছিল বাম ঘরানার রাজনৈতিক দলের হাতে। স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৬ বছরেও বেতিয়ারার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা বাম রাজনীতির পরিচয়ে বাংলাদেশের সাধারণের মুক্তিযোদ্ধা না হয়ে বিচ্ছিন্ন রয়েছেন মূলধারা হতে। যুদ্ধ করে শহীদ হয়েছেন কার জন্য, দেশের জন্য। সেই দেশ তাঁদের যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়ে তাঁদের স্মৃতি রক্ষা কিংবা স্মরণ সমাবেশ জাতি-ধর্ম-দল নিরপেক্ষ করতে পারেনি। এই ব্যর্থতা, সীমাবদ্ধতা অবশ্যই বাম সংগঠনগুলোর। তারা এই নিহত যোদ্ধাদের নিজেদের দলীয় পরিচয়ে আবদ্ধ করে সমাজে নিজেদের বিশেষ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করতে চায়। স্বাধীনতাযুদ্ধে তাদের বিশেষ ভূমিকার একটি স্বীকৃত অবস্থান সমাজ মানসে স্থায়ী করতে চায়। কিন্তু কখনই ভেবে দেখেনি যে, তা করতে গিয়ে প্রকারান্তরে তারা শহীদদের সমাজ বিচ্ছিন্ন সম্প্রদায়ে পরিণত করছে। দীর্ঘ ৪৬ বছরের আচরণে তারা অনৈক্য, বিভাজনের চর্চা দ্বারা এই মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচয় নিয়ে গেছে এক সংকীর্ণ জনবিচ্ছিন্ন দলীয় পরিম-লে। অথচ ইতিহাস যার যার অবদান, অবস্থান সুনির্দিষ্টভাবে রক্ষা করে, পরবর্তী প্রজন্মকে জানিয়ে দেয়। ইতিহাস কেউ নিজের মতো রচনা করতে পারে না। রচনা করলেও কালের আয়নায় তা টেকে না।
তাই এমন ঐতিহাসিক দিনে বিভক্ত বাম সংগঠনের নেতা-কর্মী-সমর্থক ছাড়া অন্যদের উপস্থিতি একবোরেই অনুল্লেখ্য। ২০১৭ সালের ১১ নভেম্বর এখানে বাম ঘেঁষা দল বা অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী ছাড়া আর কেউ নেই। নেই বললে ঠিক বলা হবে না। কারণ সেখানে ছাত্রলীগ না থাকলেও তারা এসেছিল। তারা এসে অনুষ্ঠানে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিল। ছাত্রলীগের এই কাজটিও অন্যান্য আরও অনেক কাজের মতোই আওয়ামী লীগকে দু-পা পিছিয়ে যেতে সাহায্য করেছে।
একটি পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, তারা ঢাকা থেকে আগত পঙ্কজ ভট্টাচার্যকে বক্তৃতা করতে দেননি। বক্তৃতার এক পর্যায়ে তাকে থামিয়ে দেওয়া হয়। সরাসরি বাক স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ। কোনো স্বাধীন দেশে বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো ৯ মাস যুদ্ধ করা দেশের মানুষ বাধাহীনভাবে কথা বলতে পারবে না, তা ভাবা যেমন যায় না, তেমনি মেনে নেওয়াও কঠিন। বক্তৃতা করতে না দেওয়ার যুক্তি ছিল তিনি বঙ্গবন্ধু এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে আক্রমণাত্মক কথাবার্তা বলছিলেন। ছাত্রলীগের ছত্রীসেনার দল মর্ত্যে অবতরণ করে পঙ্কজ ভট্টাচার্যকে থামিয়ে দেওয়ার মতো একটি মহৎ এবং অসাধ্য সাধন করে ফিরে গেলেন। প্রশ্ন হতে পারে- তারা শহীদদের স্মৃতি রক্ষা বা তর্পণে স্থানীয় বা জাতীয়ভাবে এ পর্যন্ত কী করেছেন?
বিস্তারিত না জানা গেলেও অনুমান করা সম্ভব পঙ্কজ ভট্টাচার্য কি বলতে পারেন বা কতটুকু বলতে পারেন। পঙ্কজ ভট্টাচার্য মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম একজন সংগঠক, আওয়ামী জোটের শরিক দলের একজন শীর্ষ নেতা। যিনি একসময় মন্ত্রিত্বের পদ গ্রহণের আহ্বান সবিনয়ে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। আর যদি তিনি কিছু বলেই থাকেন, তাতে বঙ্গবন্ধু কিংবা শেখ হাসিনার কী ক্ষতি হলো! রাজনীতি নিয়ে আলোচনায় মানুষ কত কথাই বলে। তাছাড়া স্বয়ং বঙ্গবন্ধু তাঁর শাসনামলে কারো কথা থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেননি। কণ্ঠরোধ করে আর যাই হোক গণতান্ত্রিক হওয়া যায় না। মওলানা ভাসানী কিংবা জাসদ সেই সময়ে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে অনেক কথা বলেছে, কই তিনিতো কাউকে বাধা দেননি।
বামদের অনৈক্য দুর্বল করেছে রাজনীতি চর্চা। বিভাজিত হতে হতে আকার আয়তনে তারা কোন পর্যায়ে গেছেন বোধ করি এ তারা আঁচ করার ক্ষমতাটুকু হারিয়েছেন। হাতি যেমন তার কানের জন্য পুরো শরীরটাকে দেখতে পায় না; বাম ঘরানার লোকজনও শুধু নিজের নিজের তত্ত্ব ছাড়া আর কিছু দেখতে পান না। বেতিয়ারায় খেলাঘর, সিপিবিসহ অন্যান্য বাম দলের কিছু নেতাকর্মী আর এসেছিলেন শহীদদের পরিজন, স্বজন বা এলাকার লোকজন। তাদের মধ্যে কোনো সমন্বয় ছিল না। যেমন নারায়ণগঞ্জ থেকে খেলাঘর, সিপিবিসহ অন্যান্য বাম দলের কিছু সদস্য, গোদনাইলের শহীদ যোদ্ধা শহিদুল্লা সাউদ, যার নামে তারা একটি স্মৃতি সংসদ প্রতিষ্ঠা করেছে, এর সদস্যরা এবং ‘সমমনা’ নামের বাম-অতীতিয় সংগঠনের সবাই নারায়ণগঞ্জের হলেও তাদের মধ্যে কোনো যোগাযোগ ছিল না। থাকলে এই আয়োজন এবং যাত্রা মানুষকে অধিক আকৃষ্ট করতে পারত, সৃষ্টি করতে পারত চৈতন্যে অভিঘাত। এই যোগাযোগহীনতা সব অঞ্চলের আগত লোকজনের বেলায় সমানভাবে প্রযোজ্য। সমন্বিতভাবে আয়োজনে অংশ নিলে শহীদদের প্রতি যথাযথ সম্মান জানানো হবে সার্থক এবং নিজেকে গর্বিত উত্তরসূরি হিসেবে চিহ্নিত করা সহজ হবে। সংশ্লিষ্ট সবাই আগামীতে বিষয়টি ভেবে দেখবেন।
লেখক : কবি ও শিক্ষাবিদ, ই-মেইল : karimreza9@gmail.com
†jLK : Kwe I wkÿvwe`, B-†gBj :