বাংলা ভাষার একটি সমৃদ্ধ অতীত রয়েছে। প্রাচীন বাংলা ভাষাগোষ্ঠীর ইতিহাস রয়েছে। অন্যদিকে ভাষাবিজ্ঞানের বিস্তৃতি নির্মাণে উর্দুর কোনো উল্লেখযোগ্য ঐতিহ্য নেই, প্রাচীনত্ব নেই। উর্দু একটি অর্বাচীন ভাষার উদাহরণ।
বলা যায়, উর্দু একটি ভূঁইফোড় ভাষা। হঠাৎ করেই একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী, যা সাধারণ জনগোষ্ঠী থেকে সর্বতোরূপেই পৃথক, তাদের সীমাবদ্ধ দৈনন্দিন প্রয়োজনে এই উর্দুর ভাষার সৃষ্টি।
উর্দু মানেই হলো সৈনিক বা সৈন্য সম্বন্ধীয় বা সামরিক স্থাপনা বা ক্যান্টনমেন্ট। সামরিক জনগোষ্ঠীর ভাষা বলেই এর নামও হয় উর্দু। যতদূর জানা যায়, মোগল শাসনের শেষ দিকে এবং ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি শাসনামলের গোড়ার দিকে সর্বভারতীয় সেনা সদস্যদের ভাব বিনিময়ের জন্য এই ভাষার প্রচলন ও চর্চা শুরু হয়। যা অনেকটা খিচুড়ির মতো চাল-ডাল-সবজি-গোস্ত সব একত্রে মিলিয়ে একটি সাধারণ খাদ্য তৈরি করা। হিন্দুস্তান বা হিন্দি ভাষার নিয়মরীতি ধার করে এই ভাষার যাত্রা শুরু। ভারতের যাবতীয় ভাষার কৃতবান কাব্য নিয়ে। কিন্তু পরবর্তীকালে অত্যধিক আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহারের মাধ্যমে একটি রূপতাত্ত্বিক ও ভাষাতাত্ত্বিক পৃথক আদল নির্মিত হয়; যা উর্দু বলে পরিচিত। বাংলাভাষার বংশ গরিমার সঙ্গে এই অর্বাচীন উর্দু ভাষার কোনোই তুলনা চলে না। বাংলা ভাষার মান উর্দুর চেয়ে অনেক উপরে, কি লেখায়, বলায়, সাহিত্য- বিজ্ঞানে। বাংলা ভাষার নিজস্ব লিপি থাকলেও উর্দুর কোনো নিজস্ব লিপি নেই, তা আরবি লিপি ধার করে লিখিত হয়।
কইতা হায়, যাইতা হায়, এরূপ বলতে পেরেই অধিকাংশ বাঙালি উর্দু বলার শ্লাঘা বোধ করলেও তা বিশুদ্ধ উর্দুও নয়, হিন্দিও নয়। তবুও যাহোক এই ভগ্ন উপায়ে বিকৃত শব্দের কারণে মোটামুটি উর্দু ও হিন্দি ভাষার সঙ্গে ভাব বিনিময়ের তাৎক্ষণিক কাজ চালিয়ে নিতে পারে বাঙালি। এভাবেই অসচেতন রূপে নিজের মাতৃভাষা বাংলার প্রতি এক ধরনের অবহেলাও প্রদর্শন করে। অধুনা ভারতীয় চ্যানেলের সুবাদে অন্দর মহল কিংবা শিশু সমাজেও হিন্দি বেশ বোধগম্য। শিশুরাও খেলাচ্ছলে হিন্দি সংলাপ আওড়াতে পছন্দ করে।
বাংলা ভাষার ঐতিহ্য ও গৌরবের জ্ঞানের অভাবের পেছনে কার্যত অনুঘটকের কাজ করে। বঙালির চির হীনমন্যতাবোধ রয়েছে, আত্মবিশ্লেষণে নিজেকে খাটো করে দেখে, তাও আত্ম-জাতি-ইতিহাসের প্রকৃত সত্যের অজ্ঞতাহেতু।
উদারনৈতিকভাবে এই উর্দু ব্যবহারের একটি ইতিবাচকতা এই যে, একটি ভিন্ন ভাষায় পারস্পরিক তথ্য আদান-প্রদানে বাংলাভাষীরা পারঙ্গম হতে পারছে। আবার নেতিবাচকভাবে নিজের মাতৃভাষা ছেড়ে অন্য ভাষার প্রতি পোষকতা দোষের দুষ্ট আচরণ বলেই চিহ্নিত হবে। কেননা উর্দু একটি ব্যাপক জনসমাজের ব্যবহৃত ভাষা নয়, নেই এর কোনো আন্তর্জাতিক প্রসারের সুযোগ বা ব্যবহারের উপযোগিতা।
পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা উর্দু হলেও, দেশের প্রকৃত জনগোষ্ঠীর সামান্য অংশই উর্দুভাষী। বরং পাঞ্জাবি, সিন্ধি, বেলুচি প্রভৃতি জনগোষ্ঠীর রয়েছে আপন আপন নিজস্ব ভাষা। ভারতেরও কিছু অঞ্চলেই উর্দু ভাষা ব্যবহার প্রচলিত এবং তা কোনো স্বীকৃত রাজ্য ভাষাও নয়।
উর্দুভাষীরা সচেতনভাবেই তাদের ভাষার প্রসার ও প্রচলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। একজন উপমহাদেশীয়কে প্রথম দর্শনেই চিহ্নিত করা যায় সহজে। এ সুযোগটুকু কাজে লাগিয়েই তারা প্রথম কথা উর্দু দিয়েই শুরু করে। মানুষের অবচেতন মনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ বাঙালিরাও বক্তার সমভাষায় উত্তর দিয়ে ফেলি অনিচ্ছা সত্ত্বেও।
এই আচরণ নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজন প্রখর সচেতনতা। মানুষের সহজাত আচরণ নিয়ন্ত্রিত হয় যে সব উপাদান দ্বারা, এই সমভাষায় বা একই ভাষায় উত্তর দেওয়াটা সেই দৃষ্টিকোণ হতেই বিচার্য। তাছাড়া উর্দুভাষীদের অযোগ্যতা হলো ওরা মোটেই বাংলা ভাষা জানে না, বা জানার আগ্রহও তাদের নেই; কেননা এককালের পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী উর্দু ভাষী ছিল, বাঙালিরা ছিলাম উর্দু দ্বারা শাসিত, শোষিত। আর সব উর্দুভাষীই নিজেদের শাসকের অংশরূপে কল্পনা করে মিথ্যা শ্লাঘা অনুভব করে। সেই উপলব্ধির জের, সুযোগ পেলেই আমাদের ওপর এখনও প্রয়োগ করে। আমরাও দীর্ঘকাল বিভাষায় নিপীড়িত হয়ে আত্মমর্যাদাবোধ ছেড়েছি। এখনো তা পুনরুদ্ধার করতে পারিনি! তাই উর্দু ভাষায় কথা বলে নিজের অজান্তেই স্বজাতি ও স্বভাষাকে দুর্বলতর করার ষড়যন্ত্রে ইন্ধন যোগাচ্ছি, অনাকাক্সিক্ষতরূপে।
মধ্যপ্রাচ্যের আরবিভাষী সমাজে আমাদের আগমন তথাকথিত উর্দুভাষীদের আগমনের বহু বছর পরে। যুক্তিসঙ্গতরূপেই ওরা ওদের ভাষার প্রতি এদেশবাসীর আগ্রহ সৃষ্টি করতে পেরেছে একটি নতুন জনগোষ্ঠীর ব্যবহৃত ভাষারূপে। আরও একটি ইতিবাচক দিক ছিল যে, উর্দু ভাষার শব্দ ভা-ারে ব্যাপক আরবি শব্দের ব্যবহার। যেসব কারণে এদেশবাসীও উর্দুকে খুব কাছের বলে ভাবতে শিখেছে। তাছাড়া একটি অপপ্রচারও বাংলা ভাষার প্রতি সাধারণ অনীহা সৃষ্টিতে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে ও তার কারণ হিসেবে পাকিস্তান সরকার ও জনগণের ব্যাপক প্রচারণা ছিল যে, পাকিস্তানিরাই কেবল মুসলমান, বাংলাদেশের অধিবাসীরা সবাই অমুসলিম এবং হিন্দু। সেই ধারণা কমবেশি এখনও অনেকে মন থেকে মুছে ফেলতে পারেনি। এমনকি বিশ্বাসও অটুট। কখনো কখনো জিজ্ঞেস করে আরবি ভাষায়, ‘কিয়া হাল হ্যায়’Ñ যেহেতু ‘ক্যাইফেল হাল’ বাক্যটির সঙ্গে প্রচুর ধ্বনিগত ও ভাষাগত মিল আছে। তাই ওটির প্রতি মানবিক আগ্রহ অধিকতর গভীর। কখনো কখনো উর্দুভাষীরা দৃষ্টিকটুভাবে বাধ্য করতে চেষ্টা করে প্রতি বক্তা বা শ্রোতাকে উর্দুতে কথা বলার জন্য। কাজেই আমাদেরও সচেতনভাবেই এই অশুভ ও অসুস্থ উর্দুভাষীদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁতভাঙা জবাব দিতে হবে।
মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘদিন কর্মব্যপদেশে বসবাসের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, নিদেনপক্ষে আরবি বা ইংরেজিতে উর্দুভাষীদের সঙ্গে কথা বলতে হবে বাংলায় না হলেও। উর্দু কোনো ক্রমেই নয়। কারণ উর্দুর বিরোধিতা করেই আজ বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস প্রতিষ্ঠা। মনে রাখতে হবে, পৃথিবীতে একমাত্র ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র বাংলাদেশ। কোনো যুক্তিহীন আচরণের দ্বারা এ গৌরব ম্লান হতে দেয়া যায় না।
লেখক : কবি, শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট, ই-মেইল : karimreya9@gmail.com