স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্রটির প্রযোজক তিনি। বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে এ অবধি তিনি ৩০টি ছবি প্রযোজনা করেছেন। আর অভিনয় করেছেন প্রায় ২০০ ছবিতে। দেশের চলচ্চিত্র শিল্পে তার অসামান্য অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে দুইবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার-এ ভূষিত করেছে।
১৯৬১ সালে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হন তিনি। ১৯৬৬-তে ৬ দফা আন্দোলনেও তিনি সক্রিয় ছিলেন। তার বিরুদ্ধে কয়েকটি মামলা এবং হুলিয়াও জারি করা হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল ছাত্রলীগ সভাপতি ছিলেন।
জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য পদ গ্রহণ করে তিনি বিতর্কিত হয়েছেন; কিন্তু এ নিয়ে তার কোনো আক্ষেপ নেই।
বলছিলাম সোহেল রানার কথা। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির পিকনিকের এক আড্ডায় অনেকের সঙ্গে অনেক কথাই শেয়ার করলেন তিনি। জানালেন তার জীবনের অজানা অনেক কথা।
আমাদের সাথে একই আসরে থাকা তার স্ত্রী ড. জিনাত বেগম, এই দম্পতির একমাত্র ছেলে নবাগত পরিচালক মাশরুর পারভেজ জীবরান, প্রযোজক খসরু, পরিচালক শাহ্আলম কিরণ, পল্লী মালেক, এস এ হক অলীক এবং অভিনেতা ওমর সানী আলোচনার প্রায় পুরো অংশজুড়েই ছিলেন। এক পর্যায়ে পরিচালক মতিন রহমান, আমজাদ হোসেন, গাজী মাহবুব, শিল্প নির্দেশক মহিউদ্দিন ফারুকও জড়িয়ে পড়েন আড্ডায়।
মাসুদ পারভেজ সোহেল রানার জন্ম ১৯৪৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায়। পৈতৃক বাসস্থান বরিশাল।
তিনি ১৯৬১ সালে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হন। তখন তিনি ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজ ছাত্র সংসদের সহসভাপতি ছিলেন। ১৯৬৫ সালে ছাত্রলীগের বৃহত্তর ময়মনসিংহের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলনে তীব্রভাবে সক্রিয় ছিলেন তিনি। তার বিরুদ্ধে কয়েকটি মামলা এবং হুলিয়াও জারি করা হয়েছিল। অনেকগুলো মামলা মাথায় নিয়ে ঢাকায় চলে এলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে আরো বেশি সাহচর্যে আসার সুযোগ হয়। ওই সময় ঢাকার কায়েদে আযম জিন্নাহ কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। আইন বিষয়ে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। থাকতেন ইকবাল হলে (বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক হল)। ওই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি ছিলেন।
১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এরপর মুক্তিযুদ্ধ। পুরো দেশ তখন স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর। যুদ্ধ শেষে চলচ্চিত্র নির্মাণের কথা ভাবলেন সোহেল রানা। প্রেক্ষাপট মুক্তিযুদ্ধ। সে ভাবনা থেকেই মাসুদ পারভেজ নামে প্রযোজক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯৭২ সালে দেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র ‘ওরা ১১ জন’ ছবির প্রযোজক ছিলেন তিনি। ছবিটি পরিচালনা করেন চাষী নজরুল ইসলাম।
১৯৭৩ সালে সোহেল রানা নাম ধারণ করে কাজী আনোয়ার হোসেন-এর বিখ্যাত কাল্পনিক চরিত্র মাসুদ রানা একটি গল্প অবলম্বনে মাসুদ রানা ছবির নায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তার নায়ক হবার পেছনে রয়েছে বেশ কিছু মজার ঘটনা।
‘মাসুদ রানা’ ছবির প্রধান চরিত্রের জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। অনেকেই ছবি পাঠান। কিন্তু বিচারক এসএম শফি, সুমিতা দেবী আর আহমেদ জামান চৌধুরী হঠাৎ একদিন মাসুদ পারভেজকে বললেন, ‘তুমিই হবে মাসুদ রানা’। আহমেদ জামান চৌধুরী তখনই নায়ক হিসেবে তার নাম ঠিক করলেন সোহেল রানা। এই ছবিটি মুক্তির মাধ্যমে দর্শকরা তাকে পর্দায় দেখতে পান ১৯৭৪ সালে।
তার পরিচালিত প্রথম ছবি ‘এপার ওপার’। তিনি ছিলেন এই ছবির নায়ক ও পরিচালক।
‘এপার ওপার’ ছবিটি নিয়েও বেশ মজার কিছু ঘটনা আছে।
মারামারির দৃশ্য থাকবে তাই ববিতা ছবিতে অভিনয় করতে রাজি হননি। সুচরিতাকে ঠিক করা হলো। শুটিংয়ের চারদিন আগে সুচরিতা জানালেন, তার নানী অসুস্থ তাই ছবিতে কাজ করতে পারবেন না। ওই পরিস্থিতিতে সুমিতা দেবী কলকাতার সোমা মুখার্জিকে নিয়ে সরাসরি সিলেটের জৈন্তাপুর চলে যান।
ছবির একটি দৃশ্যে পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়ার সময় সোহেল রানার দেহ থেকে রক্ত বের হচ্ছিল। তখন সোমা দৌড়ে এসে নিজ হাতে রক্তাক্ত স্থানে ডেটল লাগিয়ে দিলেন। বেদনার স্বরে সোহেল রানাকে বললেন, ‘যাক হাত-পা-তো ভেঙে যায়নি; ভগবান আপনাকে রক্ষা করেছেন।’
বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে আজ অবধি তিনি ৩০টি ছবি প্রযোজনা করেছেন। অভিনয় করেছেন প্রায় ২০০ ছবিতে। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির জন্মলগ্ন থেকে তিনি জড়িত ছিলেন। ২০১১ সালে বাংলাদেশ প্রযোজক-পরিবেশক সমিতির সভাপতিও নির্বাচিত হন।
২০০৯ সালে তিনি জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন। পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে প্রেসিডিয়াম সদস্য ঘোষণা করেন।
ছাত্রলীগের এক সময়ের তুখোড় এ নেতা এ প্রসঙ্গে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আওয়ামী লীগ আমাকে মূল্যায়ন করেনি, তাই আমি জাতীয় পার্টিতে সক্রিয় হয়েছি। আওয়ামী লীগের উচিত ছিল, চিত্রনায়ক খসরু ভাই, মন্টু ভাই ও আমাকে অনেক আগেই মূল্যায়ন করা।
তিনি বলেন, যে পার্টিতে (আওয়ামী লীগ) থেকে রাজ্জাক ভাইয়ের মতো সিনিয়র নেতাকেও ধারদেনা করে মরতে হয়েছে সেই পার্টিতে আর কেউ থাকলেও আমি নেই।
১৯৯০ সালের ১৬ আগস্ট তিনি ড. জিনাত বেগমকে পারিবারিক আয়োজনের মধ্যদিয়ে বিয়ে করেন। এই দম্পতির একমাত্র ছেলে মাশরুর পারভেজ জীবরান একজন নবাগত পরিচালক।
লেখক : চলচ্চিত্র পরিচালক ও সাংবাদিক